শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর অাঁকা প্রচ্ছদ, প্রকাশক: স্টুডেন্ট ওয়েজ |
নাম: রাইফেল, রোটি, আওরাত
লেখক: আনোয়ার পাশা
রিভিউ: আনোয়ার পাশার রাইফেল রোটি আওরাত একাত্তরের আনা ফ্রাংকের দিনলিপি। লেখক ২৫ মার্চের কালরাত পেরোতে পারলেও ১৪ ডিসেম্বরের হত্যাযজ্ঞ পেরোতে পারেননি। ইতিহাস বা নিয়তি যা-ই বলি, তা তাঁকে আরও কিছুকাল বাঁচিয়ে রেখেছিল হয়তো তাঁকে দিয়ে একাত্তরের অমর উপাখ্যান লিখিয়ে নেবে বলেই।
‘বাংলাদেশে নামল ভোর’ বাক্য দিয়ে যার শুরু, তার শেষ হয় অমোঘ আশার বাণী ‘মা ভৈঃ’ দিয়ে। এক সকাল থেকে আরেক সকালের এই গল্প লেখা শুরু হয় একাত্তরের এপ্রিল মাসে, আর শেষ হয় জুনে।
মাত্র তিন মাসের গল্প। কিন্তু তা যেন এক যুগ। পটভূমি বধ্যভূমি ঢাকা শহর থেকে বাংলাদেশের নিভৃত এক গ্রাম। যখন জীবন নিয়ে পালিয়ে বাঁচতে হচ্ছে দেশের ভেতর থেকে আরও ভেতরে, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার এই অধ্যাপক লিখছেন দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক কিন্তু গৌরবময় সময়ের দলিল। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম উপন্যাস রাইফেল রোটি আওরাত। বন্দিশিবিরের ভয়াবহতার মধ্যে বসে আশার অভয়বাণী শোনানোর এমন গল্প বিশ্বসাহিত্যে বিরল।
একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর আলবদরের ঘাতকেরা আনোয়ার পাশাকে নিয়ে যায়। আমরা কেবল পাই তাঁর ক্ষতবিক্ষত লাশ আর অবরুদ্ধ রাজধানীতে বসে লেখা উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি। পৃথিবীতে খুব কম লেখককেই নিজের জীবন দিয়ে লিখতে হয়েছে জাতীয় জীবনের করুণ-কঠিন ট্র্যাজিক আখ্যান।শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর অাঁকা প্রচ্ছদ, প্রকাশক: স্টুডেন্ট ওয়েজ
উপন্যাসের নায়ক সুদীপ্ত শাহীনই যেন বাংলাদেশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার গণহত্যার বিবরণ, ভুতুড়ে ঢাকায় প্রিয়জনদের তালাশ, গ্রামান্তরে পালিয়ে থাকা, মুক্তিযুদ্ধের ভবিষ্যৎ নিয়ে তর্ক শুধু সাহিত্য নয়, ইতিহাসেরও অমূল্য উপাদান। এই কাহিনি শত্রুকবলিত বাংলাদেশের অবরুদ্ধ জীবনের। যে বাংলাদেশ বিপন্ন ও ভীত কিন্তু আশাহীন নয়, সেই বাংলাদেশ কথা বলেছে তাঁর কলমে। কখন বলেছে? যখন সেই বাংলাদেশ গণহত্যার শিকার, যখন সেই বাংলাদেশ ধর্ষিত, যখন সেই বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামী। তাই রাইফেল রোটি আওরাত লেখাটাও একটা যুদ্ধ। মৃত্যুর গ্রাসের মধ্যে বসে মৃত্যুকে রোখার বিবরণ। তুলনা যদি করতেই হয়, তাহলে ইলিয়া এরেনবুর্গের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ের কাহিনি নিয়ে ফল অব প্যারিস কিংবা স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধ নিয়ে আর্নেস্ট হেমিংওয়ের লেখা ফর হোম দ্য বেল টোলস-এর কথা বলতে হয়।
একটি জাতির জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের রক্তাক্ত অধ্যায়ের মধ্যে বসে চিত্ত স্থির রেখে ভবিষ্যতের জন্য লিখে যাওয়া এক অতিমানুষিক চেষ্টা। আনোয়ার পাশা সেটাই করেছেন। আজ যদি আমরা জানতে চাই, ওই ভয়াবহ দুর্যোগে কীভাবে বেঁচে ছিল জাতির আত্মা, কীভাবে অজস্র মৃত্যু পেরিয়ে বিজয়ের পাড়ে পৌঁছানোর জেদ দানা বেঁধেছিল, তাহলে রাইফেল রোটি আওরাত-এর থেকে বেশি আর কে তা জানাবে? এ কেবল লাঞ্ছিত বাংলার হাহাকার নয়, তার রুখে দাঁড়ানোরও দলিল।
এপ্রিলেই তিনি বুঝে গিয়েছিলেন স্বাধীনতা আসন্ন। চিরকালই নায়কেরা ধ্বংসের মুখে আশার বার্তা দিয়ে যান। এ উপন্যাসের শক্তি কেবল শিল্পমানে নয়, এর সত্যদর্শনেও। হাজার বছর পরও কেউ একাত্তরের বাংলাকে ঠিকই এই উপন্যাসের আলোয় চিনে নিতে পারবে। স্বাদ পাবে বাংলাদেশের জন্মমুহূর্তের যন্ত্রণা মেশানো উদ্বেল আশার। রাইফেল রোটি আওরাত-এর শেষ কথাগুলো আজও স্বপ্ন আমাদের, ‘নতুন মানুষ, নতুন পরিচয় এবং নতুন একটি প্রভা। সে আর কত দূর। বেশি দূর হতে পারে না। মাত্র এই রাতটুকু তো। মা ভৈঃ। কেটে যাবে।’
ডাউনলোড
0 comments: